পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও অপকর্মঃ ১৭ এপ্রিল হানাদার বাহিনী গাইবান্ধায় প্রবেশ করে হত্যা করে মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিনকে।পাকিস্তানী বাহিনী গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এখান থেকেই যুদ্ধকালীন সময়ে গোটা গাইবান্ধার মুক্তিকামী, নিরাপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা, নারী ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা তৈরী এবং আক্রমণ পরিচালনা করা হতো। এইসব বর্বরোচিত কাজে সহায়তাকারী এদেশীয় দালালরা ছাত্র-যুব-জনতাকে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিলে নরপশুরা নির্মমভাবে তাদের হত্যা করতো এবং মা-বোনদের ধর্ষণের পর হত্যা করতো। গাইবান্ধা প্রবেশের পরপরই হানাদার বাহিনী তাদের দালালদের মারফত খবর পেয়ে ছুটে যায় কামারপাড়ায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। কামারপাড়া যাবার পথে হানাদাররা লক্ষ্মীপুরে মুক্তিকামী ৫জন বাঙালি সন্তানকে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করার পাশাপাশি গোটা গাইবান্ধায় বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণ করে নরপশুরা বিভিষীকার রাজত্ব কায়েম করেছিল। পাকিস্তানী বাহিন পলাশবাড়িতে সিএন্ডবি ডাক বাংলোয় ঘাঁটি গাড়ে। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী মানুষ ধরে এসে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করতে থাকে। অন্যান্য থানাতেও তারা ঘাঁটি বানিয়ে অপকর্ম চালায়। রণাঙ্গণের সুঃসাহসিক যুদ্ধঃ ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদের সভাপতিত্বে সামরিক অফিসারদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। মেজর জিয়ার নেতৃত্বে জেড ফোর্স গঠন করা হয়। গাইবান্ধা অঞ্চল ছিল এই জেড ফোর্সের অধীন। সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে জেড ফোর্স সিলেট অঞ্চলে চলে গেলে এ অঞ্চলে গড়ে ওঠে ১১নং সেক্টর। এতে নেতৃত্ব দেন মেজর তাহের। উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১১৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মানকার চরের কামাক্ষা মন্দিরের টিলায় ১১নং সাব সেক্টরের গোড়া পত্তন ঘটে। এই সাব সেক্টরের কমান্ডারের দয়িত্ব পান বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার মোঃ শফিক উল্ল্যা এবং পরবর্তীতে ফ্লাইট লেঃ হামিদুল্লাহ খান। কামালপুরে সম্মুখ যুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহের গুরুতর আহত হলে মাহিদুল্লাহ খান সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাব সেক্টরের উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন খায়রুল ইসলাম ওরফে নজরুল ইসলাম, এম.এস নবী লালু, রোস্তম আলী, মাহবুব এলাহী রঞ্জু, আমিনুল ইসলাম সুজা, ছোট নূরু, মবিনুল ইসলাম জুবেল, মোজাম্মেল হক মন্ডল, রফিকুল ইসলাম হিরু, বজলার রহমান, মহসীন, গৌতম, সামচুল আলম, বজলু, বন্দে আলী, মান্নান, নাজিম, বক্কর, তোফা, আহসান, কাসেম, হায়দার, মজিবর, জিন্নু, মহববত প্রমুখ। এদের মধ্যে এম এন নবী লালু, খায়রুল আলম, মাহবুব এলাহী রঞ্জু, রোস্তম আলী কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অপারেশন শুরু করতে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তৎকালীন গাইবান্ধা মহকুমার অধিকৃত এলাকা এবং ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপাড়ের মুক্ত অঞ্চলে অবস্থিত কালাসোনা গাইবান্ধা থেকে মাত্র ৬/৭ মাইল দুরে মানস নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। এই দ্বীপটি উত্তর রণাঙ্গণে যুদ্ধ কৌশলের অন্যতম একটি অস্থায়ী ঘাঁটি। এই ক্যাম্প থেকে গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকার শত্রুর উপর অভিযান পরিচালিত হতো। ঐ দ্বীপাঞ্চলটির বিভিন্ন স্থাপনা মিলে ১১নং সেক্টরের একটি গেরিলা কোম্পানী দক্ষতার সাথে অবস্থান নিয়েছিলো এবং প্রায় প্রতিদিন নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর উপর আক্রমণ রচনা বা আক্রমণ প্রতিহত কর নিজেদের অবস্থান আরও সংহত করেছে। এখানে কিছু দুঃসাহসিক যুদ্ধের বর্ণনা উপস্থাপন করা হলোঃ
১। বাদিয়াখালী সড়ক সেতু এলাকার যুদ্ধঃ মাহবুব এলাহী রঞ্জু ও রোস্তম আলীর নেতৃত্বাধীন দুটি সেকশন এল এম, জি, স্টেনগান, এস এল আর, রাইফেল ও গ্রেনেড নিয়ে যৌথভাবে গাইবান্ধা উপজেলাধীন বাদিয়াখালী রোড-ব্রীজ এলাকার অভিযান পরিচালনা করেন। নৌকাযোগে তারা ব্রীজের কাছে পৌছেন। ব্রীজ ঘিরে ছিল শক্র সেনাদের বাংকার। এসব বাংকারে হানাদার সৈন্য ও রাজাকাররা ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহারারত ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধারা আধঘন্টা সময়কাল একটানা গুলি বর্ষণ করে শক্র সেনাদের উপর। উভয়পক্ষে গুলি বিনিময় হলেও ব্রীজটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে নেয়া সম্ভব হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান থেকে ক্রলিং করে রুস্তম সেকশনের সামছুল আলম ও রঞ্জু সেকশনের জুবেল গ্রেনেড নিয়ে শক্র সেনাদের বাংকারের কাছে গিয়ে পরপর ১০ টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বাংকারের উপর। হানাদাররা ঐ সময় কোন রকমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ডিনামাইট দিয়ে ব্রীজটির এক অংশকে ধ্বংস করে দেয়। ঐ আক্রমণ অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন ওয়াসিকার মোঃ ইকবাল মাজু, ছোট নুরু, মাহমুদুল হক শাহজাদা, কামু, বন্দে আলী, হামিদ, নাজিম, আলিম, মহসীন, বজলুর, সহিদুল, ঠান্ডু, ফজলু প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যান গলনার চর ও কালাসোনার চরে। পরদিন ফুলছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা গজারিয়া ইউনিয়নের আব্দুল মেম্বারকে হানাদার বাহিনীর দোসররা হত্যা করে।
২। হরিপুর অপারেশনঃ ২৯ মে কাজিউল ইসলাম নৌকা যাত্রীদের কাছে জানতে পারেন যে, সুন্দরগঞ্জ কালীবাজারে হানাদার বাহিনী কয়েকজন রাজাকার নিয়ে অবস্থান করছে। কোম্পানীর কমান্ডার বি এস এফ এর সাথে যোগাযোগ করলে ৬ জুন বি এস এফ জানায় রাতে কালিরবাজার অপারেশন করতে হবে। কারণ তারা জানতে পারে যে সেখানে থেকে গুদামজাত পাট পরদিন হানাদার বাহিনী শান্তি কমিটির মাধ্যমে স্থানান্তর করবে। সেই অনুযায়ী ও পুর্বপ্রস্ত্ততির ভিত্তিতে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে কালিবাজার ও হরিপুর অপারেশন পরিচালিত হয়। ২৮ জন মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা পরিচালিত অপারেশনে শান্তি কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও তার দুজন সশস্ত্র রাজাকার গ্রেফতার হয় এবং দালাল রাজাকারদের লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করা হয়। অপারেশন শেষে ফেরার পথে নৌকাগুলো বৃহ্মপুত্র-এর পশ্চিম তীর থেকে প্রায় ৩শ গজ দুরে যেতে না যেতেই হানাদার বাহিনী নদীর তীর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর মেশিনগানের গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা নৌকা থেকে গুলি চালায়। এতে অবশ্য কোন পক্ষেরই তেমন কোন ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। তথ্য- gaibandha.gov.bd