৩। কোদালকাটির যুদ্ধঃ ১৮ আগষ্ট ভোর না হতেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অন্যতম যুদ্ধ কোদালকাটির যুদ্ধ শুরু হয়। হানাদার বাহিনী নৌ, স্থল ও আকাশ পথে একযোগে আক্রমণ করে। অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর ত্রিমুখী বর্বোরচিত হামলা প্রতিরোধ হতে থাকে জেড ফোর্স অধিনায়ক মেজর জিয়ার সার্বিক নেতৃত্বে। সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর ৩’’ মটারটি এক পর্যায়ে বিকল হয়ে যায়। সুবেদার আলতাফ উম্মাদের মত ছুটাছুটি করতে থাকেন। মুখোমুখী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যুদ্ধরত রাইফেল, ষ্টেশন ও এল এমজিধারী বীর যোদ্ধাদের যুদ্ধে কভারিং ফায়ার সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে হানাদার বাহিনীর গানবোট থেকে শেলিং, এয়ার এ্যাটাক ও ভারী অস্ত্র সহ মেশিনগানের গুলির গগনবিদারী শব্দে মানকার চরাঞ্চল যেমনি কাঁপতে থাকে তেমনি গুলিতে গাছ-পালা, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হতে থাকে। ভোর রাত থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর ত্রিমুখী হামলায় গুলি বর্ষণ এক মুহুর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি। ২ এম এফ কোম্পানী সম্মুখভাগের (পশ্চিমমুখী) ডিফেন্স উইথড্র করতে তখন বাধ্য হয়েছেন এবং ফাস্ট বেঙ্গলের পশ্চিমুখী একটা অংশ উইথড্র করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা আগের দিনের প্রতিশ্রুত সরবরাহ পায়নি এবং বি এস এফ এর কভারিং ফায়ার হয়নি। ইতিমধ্যে মজিদ মুকুলের নেতৃত্বাধীন অংশের পশ্চিম পার্শ্বের বাংকারগুলো ঘেরাও হয়েছে। এটি এম খালেদ দুলু ও শওকত আলী ঘেরাও থেকে আখক্ষেতে সুযোগ বুঝে আত্মগোপন করেন। কিন্তু বাদিয়াখালীর বীরযোদ্ধা আলতাফ ও আঃ সামাদ রক্ষা পান না। দুজনকেই বাংকারের মধ্যেই হানাদাররা খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে। দুই বীর সহযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের চিৎকার শুনে পাশের বাংকার থেকে বেরিয়ে দেওয়ানগঞ্জের বীরযোদ্ধা নজরুল পাশের বাংকারে অবস্থানরত মজিদ মুকুলকে অনুরোধ করে ইউথড্র করতে। কিন্তু শহীদ সামাদ ও আলতাফের করুণ চিৎকারে শুনে তিনি তার দলবল নিয়ে হটে যেতে পারেনি। নজরুল আখ খেতে ঢুকতেই পদব্রজে সারিবদ্ধভাবে আগত হানাদারদের দুজনে ইয়া আলী বলে মজিদ মুকুলের বাংকার চার্জ করে। মজিদ মুকুল বাংকারের এক পাশে অবস্থান নিয়ে গ্রেনেড ব্রাষ্ট করেন। সর্ববামের ডিফেন্স থেকে হাবিলদার মকবুল মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করেন মজিদ মুকুলের বাংকারে চার্জকারী হানাদারদের উপর। বীর সহযোদ্ধা মকবুলের মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে হানাদার শক্রসেনারা। এসময় পিছনের আখ খেত থেকে দুলু বার বার অনুরোধ করছিলেন মজিদ মুকুলকে উইথড্র করতে। তিনি তাকে পিছন সারি মজিদ মুকুলের বাংকার অতিক্রমকালে ২ এম এফ কোম্পানীর উত্তর পশ্চিমমুখী ডিফেন্সের সাহসী বীর বাঙ্গালী সৈনিক বরিশালের কাশেম তার হাতে থাকা এল এম জি থেকে ব্রাশ ফায়ার করলে বেশ ক’জন শক্র সেনা নিহত হয়। একই সময়ে হানাদারদের দুর পাল্লার কামানের শেলিং এ ফাষ্ট বেঙ্গলের বীর সহযোদ্ধা মকবুল আহত হন। তিনি তার মেশিনগান নিয়ে পুরো সেকশন উইথড্র করেন। অবশেষে মজিদ মুকুল উইথড্র করে আখ ও কাশবন পেরিয়ে নদীর পাড়ে অবস্থান নেন। সেখানে সহযোদ্ধা নজরুল ও দুলু অপেক্ষা করছিল। অপরদিকে উইথড্র করে যাওয়া সহযোদ্ধারা সুবেদার আলতাফের কাছে জানতে চান কেন কভারিং ফায়ার দেয়া হলো না? সহযোদ্ধা কমান্ডার সুবেদার আলতাফ জেড ফোর্স অধিনায়ককে ক্ষয় ক্ষতির বর্ণনা দিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ক্ষোভে দুঃখে তার পিস্তল উচিয়ে গুলি করতে উদ্যত হন। মেজর জিয়া পিস্তলটি ধরে শান্ত হবার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘‘সহযোদ্ধা আলতাফ জেড ফোর্সকে সিলেট সেক্টরে যদি প্রেরণ না করা হত এবং সবাই পুর্বাপর অবস্থানে থাকতো তাহলে আমরা আরো সফল হতে পারতাম।কিন্তু বেশীর ভাগ বাহিনী ক্লোজ করায় ও ভারতীয় বি,এস, এফ প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার ফলে ঐ দিনের যুদ্ধে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। হানাদার বাহিনীর ক্ষয়-ক্ষতির ফিরিস্তি তখনও পুরো জানা যায়নি। তবে গুলি বন্ধ হয়েছে। গানবোট থেকে মাঝে মাঝে মেশিনগানের গুলি ছুড়ছে আর দু’একটা করে শেলিং করছে। এরই মধ্যে বীরযোদ্ধা এবি সিদ্দিক সুফী খবর পৌঁছায় যে আমাদের মর্টারটি বিকল হওয়ার আগেই তাদের মর্টার বিকল হয়েছে। এছাড়া পাশের সেকশন থেকে নায়েক মজিদ রকেট লাঞ্চার দিয়ে শেলিং করে শত্রুসেনাদের একটা গান বোট ও একটা লঞ্চের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছেন। আর তিনি সহ বীর সহযোদ্ধা আনোয়ারুল কাদির ফুলমিয়া, রঞ্জু, আলমগীর, শরিফুল ইসলাম বাবলু, ডাঃ মনছুর এবং হাবিলদার মনছুর, নায়েক মফিজ উল্লাহ ও নয়েক আবু তাহেরের কভারিং ফায়ারে নায়েক রেজাউল তার সেকশন নিয়ে উইথড্র করতে পেরেছিলেন। এদিকে বীর সেনা বিক্রমপুরের আবুল কাশেমের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন, হান্নান, বাবলু, রেজা নীর পূর্বপাড় থেকে সবার অজান্তে শুধুমাত্র সুবেদার আলতাফের পরামর্শে ছোট নৌকা নিয়ে পশ্চিম পাড়ে গিয়ে মজিদ মুকুল, দুলু ও নজরুলকে পার করে নিয়ে আসে। শুধু দুই সহযোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। জেড ফোর্স তাদের ডিফেন্স ইউথড্র করলে, হানাদার বাহিনী তাদের সহযোদ্ধা হানাদারদের মরদেহ দেখে কোদালকাটি চরের বাসিন্দা যে দু’চারজন মানুষ ছিলেন তাদের হত্যা করে।মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ভ্যাত কোদালকাটির যুদ্ধে ৩৫০ জন পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য নিহত হয়। জেড ফোর্সের ২ এম এফ কোং হানাদার বাহিনীর ৩টা এলএমজি স্টেনগান ও ৬টা চাইনিজ রাইফেল এবং প্রচুর গোলাবারুদ ও হেলমেট দখল করতে সক্ষম হয়। ১৮ তারিখের ত্রিমুখী আক্রমণের পূর্ববর্তী ৬দিন হানাদারদের সাথে গুলি বিনিময় হয়েছিল। এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধে জেড ফোর্সের ২ এম এফ কোম্পানীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।জেড ফোর্স অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন পরিচালিত কোদালকাটির যুদ্ধে সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বাধীন ২ এম এফ কোং ও লেঃ আসাদের নেতৃত্বাধীন ফাষ্ট বেঙ্গলের একটা কোম্পানীর বীর যোদ্ধাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাক হানাদার বাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল হারিয়ে লঞ্চযোগে চিমারিতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
৪। রসুলপুর স্লইস গেট আক্রমণঃ তারপর রসুলপুর স্লুইস গেটে অবস্থানকারী পাক সেনাদের উপর আক্রমনের পালা। কালাসোনার চরে ইউপি সদস্য মকসুদ আলী ও রহিম উদ্দিন সরকারের সহায়তায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানী কমান্ডার এম এন নবী লালু ১৫ অক্টোবর রাতে খবর পান স্লুইচ গেটের হানাদার পাক সেনাদের বেশ কজন গাইবান্ধায় যাওয়ায় শত্রুদের সংখ্যা কম। তিনি প্লাটুন কমান্ডারদের সাথে পরামর্শকমে ত্বড়িত স্লুইচ গেটে আক্রমণে সিদ্ধান্ত নেন। তখন কালাসোনার চরে সুন্দরগঞ্জ ও দারিয়াপুর ব্রীজ অপারেশনের জন্য রঞ্জু কোম্পানী এবং গাইবান্ধাকে একটা পকেটে পরিণত করার পরিকল্পনার আওতায় সাইফুল আলম সাজার কোম্পানী ও খায়রুল আলম কোম্পানী অবস্থান নিয়েছিলো। পাশের চরেই ছিল রোস্তম কোম্পানী। পিছনে মোল্লার চরে পালোয়ান কোম্পানী ও মতি মিয়াদের পরিচালিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। লালু কোম্পানীর পরিকল্পনার আওতায় সাইফুর আরম সাজার সাজা কোম্পানী ও খায়রুল আরম কোম্পানী অবস্থান নিয়েছিলো। লালু কোম্পানীর পরিকল্পনা মতে এক্সপ্লোসিভ গ্রুপ হিসেবে সুজা কোম্পানীর টোয়াইসি আলমনির নেতৃত্বে একটি প্লাটুনকে স্লুইচ গেট বিধ্বস্তকরণ, লালু কোম্পানীর দুলাল কাদেরী ও আঃ কাইয়ুম টিপুর নেতৃত্বাধীন প্লাটুনকে জমিদার বাড়িতে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা, মোজাম্মেল হক মন্ডলের নেতৃত্বাধীন প্লাটুনকে কামারজানী থেকে হানাদার সৈন্যরা না আসতে পারে তার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ ও আব্দুল বাসেত সরকারের নেতৃত্বে গ্রেনেড নিয়ে সজ্জিত সুইসাইড গ্রুপ রে, সাদেকুর রহমানের নেতৃত্বাধীন এক্সপ্লোসিভ গ্রুপ নিয়ে সাহসী বীর যোদ্ধা এম এন নবী লালু ঐ রাতেই স্লুইচ গেটে পৌঁছেন। বল্লমঝাড়ের সামছুল, দুদু, আঃ সাত্তার, বজলার ও সোবহান এবং আঃ কুদ্দুস ও ফুলছড়ির লুৎফরকে নিয়ে বাসেতের নেতৃত্বাধীন সুইসাইড টিম ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক সেনাদের উপর। হানাদার বাহিনীকে রক্ষায় কামারজানি থেকে পাক সেনারা এগিয়ে আসে। তারা মোজাম্মেল হকের প্লাটুনের যোদ্ধাদের গুলির রেঞ্জের আওতায় এলেই মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। কোম্পানী কমান্ডারের নির্দেশে লুৎফর রহমান এক্সপ্লোসিভ গ্রুপকে স্লুইচ গেট বিধ্বস্ত করার নির্দেশ দেন। আরমনির নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেকুর, আঃ বাকী, জলিল, মোজাফ্ফর আদেল ও লুৎফর ব্রীজটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেন। লালু কোম্পানীর বীর যোদ্ধারা ২ ঘণ্টাকাল গুলি বিনিময় করেন। সুইসাইড টিমসহ মুক্তিযোদ্ধারা ৭জন পাকিস্তানী মুজাহিদকে গ্রেফতার করতে ও ৩জন পাক সেনাকে খতম করতে সক্ষম হন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা ৪টি এলএমজি দখল করে এবং হানাদার বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। তথ্য- gaibandha.gov.bd